মুয়াজ্জিন হুজুর
যুবক বয়সের বড় জুব্বা পরিহিত দাড়িওয়ালা হুজুর লোকটা আমার টেবিলের ঠিক সামনের চেয়ারেই বসল। সালাম দিলাম। চেহারায় একটু চিন্তিত ভাব বোঝা গেলেও মুচকি হাসি দিয়ে জবাব দিলেন, ওয়ালাইকুম সালাম।
হুজুরদের প্রতি ভালো লাগা আমার বংশগত। ১৭ শ শতকের শেষের দিকে যখন আমার পূর্বপুরুষরা এই দেশে এসেছিল সেটা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যেই। আমার বাবা যেমন একজন আলেম হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পান। তেমনি তাকেও আলেম ওলামাদের যথেষ্ট সম্মান দিতে দেখেছি।
ওয়েটার এসে জিজ্ঞাসা করলেন কি খাবেন?
হুজুর বললেন, ভাত আছে? ভাত দিন।
আমাকে জিজ্ঞাসা করাতে বললাম, রুটি আর ডাল-ভাজি।
কিছুক্ষণ পরে ওয়েটার আমার জন্য রুটি ডাল-ভাজি আর হুজুরের জন্য ভাত নিয়া আসলেন।
হুজুর হাতে লবণ নিয়ে ভাত নাড়ছেন।
ওয়েটার জিজ্ঞাসা করল, কি দিব? রুই, ইলিশ, মুরগীর ঝাল ফ্রাই, গরু ও খাঁসির মাংস।
ভর্তা নাই?
না, শেষ হয়ে গেছে।
সবজি আছে?
না, তাও শেষ হয়ে গেছে।
ডিম নাই?
খুবই বিরক্তির স্বরে ওয়েটার বলল, না। এইসব বড় রেস্টুরেন্টে ডিম ভুনা থাকেনা। এখন বলেন কি দিবো?
রুই মাছ কত?
৮০ টাকা।
ইলিশ আর গরুর মাংসের দাম?
ইলিশ ১০০ আর গরু ৯০ টাকা।
খুবই অসন্তুষ্টি নিয়ে হুজুর বললেন, রুই মাছ দিন।
ওয়েটার রুই মাছ নিয়া আসলো।
হুজুর রুই মাছের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, গরুর মাংস যেন কত বলছিলেন?
৯০ টাকা।
ঠিক আছে এইটা নিয়া যান, গরুর মাংস দিন।
ওয়েটার কিছুক্ষণ পর গরুর মাংস নিয়া আসলেন। হুজুর দেখেই অবাক হয়ে বললেন, এত কম কেন? ৯০ টাকায় এত কম মাংস!!
ওয়েটার কিছু না বলে একটু বিরক্তির ভাব নিয়ে চলে গেলেন।
আমি সব কিছু দেখতেছিলাম। হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাড়ি কোথায়?
এইতো শহরের কাছেই। মান্নান নগর।
আপনি কি করেন?
মসজিদের মুয়াজ্জিন। আর সেই সাথে সকাল বেলা মক্তবে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোরআন শিক্ষা দেই।
খুব গর্বের সাথে উনি কথাগুলো বলছেন। আমি বললাম, খুবই সম্মানের পেশা আপনার।
ওয়েটার আবার আসলো।
অন্য টেবিল দেখিয়ে বললেন ওইযে ভাজি দিয়ে রুটি খায়। ওই ভাজি দিয়া ভাত খাওয়া যাবেনা? মাংস খাবনা তাহলে।
ওয়েটার খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, দূর মিয়া। ভাতের সাথে ওই ভাজি দেয়ার নিয়ম নাই। আপনি এখানে আসছেন কেন? আপনার পৌরবাজারের ভিতরে হোটেল গুলোতে যাওয়া উচিত ছিলো। ওখানে আলু ভর্তা, সবজি সব পেতেন।
হুজুর এসব শুনে কিছুই বললেন না। চুপ করে মাংস দিয়ে খাওয়া শুরু করলেন।
আমার খাওয়া শেষে, হাত ধুইতে উঠে ওয়েটারকে চুপেচুপে বললাম, রুই মাছটা নিয়ে এসে ওনাকে দিন। টাকা আমি দিবো। আর শুনুন, গরীব মানুষদের সাথে বাজে ব্যবহারের অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। ও আরেকটি কথা ওনাকে বলবেন না যে আমি দিতে বলছি। বলবেন এটা আপনাকে এমনিতেই ফ্রি দেয়া হইছে।
হুজুর রুই মাছ পেয়ে খুব খুশি হলেন। উনি খাচ্ছেন। আমি চা পান করতে করতে উনার সাথে কথা বলছি। সে অনেক কথা। এখন হসপিট্যাল থেকে এখানে আসছেন। স্ত্রী অসুস্থ। বাচ্চা হবে। আগামীকাল ডাক্তার সিজার করার সময় নির্ধারণ করলেন। অনেক টাকা লাগবে। তিন হাজার টাকা বেতনে মুয়াজ্জিনের চাকুরী করেন আর মক্তব থেকে পান হাজার খানেক। বিয়ে করেছেন বছর দেড়েক হলো। মা আর বউকে নিয়ে ছোট পরিবার। তারা বাড়িতে থাকেন। উনি থাকেন মসজিদে। যে বাড়িতে মসজিদ ওই বাড়িতে বিভিন্ন ঘরে ভাগ করে তিন বেলা খাওয়া চলে। বললেন, বাড়তি কোন খরচ নেই। সব টাকা বাড়িতে মাকে পাঠাই। ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ্।
এখন কর্মস্থলে যাচ্ছি। গ্রামের মানুষ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। ভাবলাম এত রাতে গিয়ে খাবারের জন্য তাদের বিরক্ত না করি। তাই এখান থেকে খেয়ে নিলাম। বুঝতে পারিনি এখানে ভাত খেতে এত টাকা লাগবে। ভেবেছি ভর্তা বা সবজি কিছু একটা পাওয়া যাবে।
আমরা কথা বলতে বলতে রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে আসলাম। হুট করেই জানতে চাইলাম, আপনার স্ত্রীর সিজার করতে যে টাকা লাগবে এটা কোথায় পাবেন?
উনি সহাস্য জবাব দিলেন, আমার স্ত্রী অনেক গুণবতী। একটা সংস্থা থেকে ফ্রি সেলাই মেশিন পেয়েছিল। জামাকাপড় সেলাই করে কিছু টাকা জমিয়েছে। ওটা দিয়েই আল্লাহ্র রহমতে চিকিৎসার টাকা অনেকটা হয়ে যাবে। আর বাকিটার জন্য চেষ্টা করছি। ইনশাআল্লাহ্, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
জীবনের প্রথম টিউশানির বেতন সেদিনই পেয়েছিলাম। ভাবলাম, প্রথম আয় দিয়ে একটা ভালো কাজের সুযোগ হাতছাড়া করা যায়না। পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে বললাম, আল্লাহ চাইলে আগামীকাল আপনার যে সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখতে যাচ্ছে তার জন্য আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। উনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন, নিতে অনাগ্রহ দেখালেন। বললাম, একজন মুসলিম ভাই থেকে এমন হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েজ আছে। অনেক পীড়াপীড়ির পরে উনি টাকাটা নিলেন। বিদায় জানিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে অটোতে উঠলাম। বিদায়ের সময় উনার তৃপ্তির হাসিটা যেন এখনো চোখেচোখে ভাসছে।
বাসায় আসতে আসতে ভাবছি, এত কম উপার্জন করেও আল্লাহ্র প্রতি কত সন্তুষ্টি। সত্যিই এদের উপার্জন বরকতময়।
বাসায় এসে পরেরদিন একটা জিনিষ ভেবে খুব আফসোস হয়েছিল। কেন উনার ফোন নাম্বারটা চাইলাম না। অন্তত জানতে পারতাম উনার স্ত্রী সুস্থ আছে কিনা? ছেলে হয়েছে না মেয়ে হয়েছে?
-মুহিববুল্লাহ আল মামুন
(১৯০৩২০১৮)
কোন মন্তব্য নেই