নোয়াখালী বিভাগ কেন চাই?
নোয়াখালী বিভাগ চাই।
হুম। আমিও চাই। নোয়াখালীর মানুষের দাবির পক্ষে আমি। নোয়াখালী বিভাগ চাই মর্মে সবার ট্রল বা ব্যঙ্গাত্মক কথা আমাকে মর্মাহত করেছে। তাই এই স্ট্যাটাস লিখতে বসা।
প্রায় চার বছর নোয়াখালীতে। জীবনের সাথে নোয়াখালী নামটা জড়িয়ে গেছে। নিজের হোম টাউনের পরে নোয়াখালীই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। যদি বলি নোবিপ্রবিকে ভালবাসি তবে নোয়াখালীকে ভালবাসতে বাধ্য।
নোয়াখালীর সাথে আমার পারিবারিক একটা টান আছে। আমার শ্রদ্ধেয় দাদা(আনুমানিক ১৯১৮-১৯২৩) এবং আমার বাবা(১৯৬০-১৯৬৫) নোয়াখালীতে পড়াশুনা করেছেন। বাবার থেকে অনেক গল্প শুনতাম। আর এই জন্যই ছোট থেকে নোয়াখালী শব্দটা আমার কাছে খুব পরিচিত ছিলো। নোয়াখালীর সাথে পটুয়াখালীর যাতায়াত ব্যবস্থা খুব বাজে হওয়ার পরও সবচেয়ে আদরের সন্তানটিকে বাবা নোয়াখালীতে পড়তে দিছিলেন শুধু পারিবারিক ইতিহাসের জের ধরেই। তাঁর থেকে নোয়াখালী সম্পর্কে সবসময় পজিটিভ শুনেছি। দাদা এবং বাবার পড়াশুনার সূত্র ধরেই আমারো চান্স পাওয়ার পর নোয়াখালীতে পড়ার আগ্রহটা বেশিই ছিলো।
যাইহোক এগুলো আবেগের কথা। যা কখনোই নোয়াখালী বিভাগ হওয়ার পক্ষে থাকার যুক্তি হতে পারেনা।
অনেকে বলে নোয়াখালী বিভাগ হওয়ার যোগ্য না। আমি বলবো নোয়াখালী বিভাগ হওয়ার পুরোপুরি যোগ্যতা রাখে। এর স্বপক্ষে যুক্তিও আছে।
নোয়াখালীবাসী নোয়াখালীকে বিভাগ হিসেবে দেখতে চায়। এ নিয়ে তারা বেশ কয়েকবার মানববন্ধন করেছে। প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। সামাজিক সাইট গুলোতে তাদের বেশ সরব দেখা যায়।।
অনেকেই নোয়াখালী বিভাগ দাবি নিয়ে ট্রল বা ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করছে। যে কোন অঞ্চলের মানুষই সরকারের কাছে কোন কিছু দাবি করার অধিকার রাখে। দাবির উপযুক্ততা আর সম্ভাব্যতা বিবেচনায় সরকার চাইলে দাবি মেনে নিতে পারে আবার নাও নিতে পারে। দাবির যৌক্তিকতা খোঁজার পক্ষে বিপক্ষে অনেক লোকই থাকবে। আলোচনা-সমালোচনাও হবে। তবে অহরহ ব্যঙ্গাত্মক কথা বলে পাবলিক প্লেসে একটা অঞ্চল আর অঞ্চলের মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলা কতটা যৌক্তিক আমার জানা নেই।।
নোয়াখালী বিভাগ হওয়া কিংবা এর উন্নয়নে আমার কোন ক্ষতি নেই। তারা বিভাগ দাবি করতেই পারে। যৌক্তিক হলে সরকারই মেনে নিবে। আর যদি সরকার মনে করে বিভাগ হওয়ার যোগ্যতা নাই তো হবেনা।
একটা অঞ্চল নিয়ে আপনি মজা করতে পারেন। তবে আঞ্চলিক কোন দাবি নিয়ে মজা করা ব্যাপারটা কেমন যেন। হয়ত এটাই প্রথম। আর যদি মজাটা অতিরিক্ত হয়ে যায়। তখন আর মজা থাকে না। হয়ে যায় হেয় প্রতিপন্ন করে কাউকে বা কোন অঞ্চলকে অপমানের শামিল। এতে আপনার নোয়াখালীর বন্ধুটি কষ্ট পেতে পারে।।
যদিও নোয়াখালীর বন্ধুটি আপনার ব্যঙ্গাত্মক মন্তাব্যকে মজা হিসেবে নিচ্ছে। তারপরও একটু হলেও তার খারাপ লাগছে। একবার ভাবুন আপনার অঞ্চল নিয়ে এমন মন্তাব্য আপনার কতটা সহ্য হতো। আমাদের অঞ্চলের(বৃহত্তর বরিশাল) মানুষ এতটা সহ্য করতো কিনা সন্দেহ আছে।।
যাইহোক নোয়াখালী বিভাগ হওয়ার দাবির পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরতে চাই।
নোয়াখালী কেন বিভাগ হওয়া উচিত?
নিম্নোক্ত কিছু ব্যাপার আমলে নিলে নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষনা করার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক ঘাটাঘাটি করে চেষ্টা করেছি কিছুটা তুলে ধরার।
১) সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্যঃ বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম জনপদ নোয়াখালী। প্রায় ৩ হাজার বছর পূর্বেও পৃথিবীর মানচিত্রে এ জনপদের অস্তিত্ব ছিলো। ব্রিটিশ আমলে নোয়াখালী খুব গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল ছিলো।
ব্রিটিশ, পাক আর বাংলাদেশ প্রতিটি শাসনামলে নোয়াখালীর অবদান ও প্রভাব উল্লেখ করার মতো। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নোয়াখালী সক্রিয় ছিলো। যেমন ১৮৩০ সালে নোয়াখালীর জনগণের জিহাদ আন্দোলন ও ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নোয়াখালীর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ভাষা সংগ্রামে শহীদ সালাম, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন যার প্রমাণ বহন করে। সুতরাং ইতিহাস ঐতিহ্যের বিবেচনায় নোয়াখালী বিভাগ হওয়ার দাবী রাখে।
২) বেশ পুরানো জেলাঃ ১৭৮৭ সালে সমগ্র বাংলাকে ১৪টি জেলায় ভাগ করা হয়। তখন ১৪ টির মধ্যে ভুলুয়া নামে নোয়াখালী অঞ্চলে একটি জেলা ছিল।
পরে ১৭৯২ সালে ত্রিপুরা নামে নতুন জেলা হলে ভুলুয়াকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮২১ সালে আবার নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে ভুলুয়া নামে স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলার নামকরণ নোয়াখালী করা হয়। বৃহত্তর জেলা সিলেট ও বরিশাল এবং রংপুর বিভাগ হলেও সুপ্রাচীন জনপদের এই বৃহত্তর জেলাটি এখনও বিভাগ হয়নি। বেশ পুরানো জেলা হিসেবেও নোয়াখালী বিভাগ হওয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
৩) জনসংখ্যাঃ বৃহত্তর নোয়াখালী এবং এর আশে পাশের প্রায় ১ কোটি মানুষ নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। নোয়াখালী বিভাগ হলে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। যা সিলেট বরিশালের জনসংখ্যার থেকে অনেক বেশি।
৪) ভৌগলিক অবস্থান এবং আয়তনঃ ভৌগলিক ভাবে নোয়াখালী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। উপকূলীয় এ অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৮,০০০ বর্গ কিলোমিটারের মতো। যার মধ্যে বৃহত্তর নোয়াখালীর আয়তন ৫,৯৬৯.৭৩ বর্গ কিলোমিটার। বাকিটা নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষাভাষী অন্যন্য অঞ্চল। এছাড়া সম্প্রতি জেগে ওঠা দ্বীপ ও ছোট ছোট চর মিলে এর আয়তন হবে প্রায় ২০,০০০ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
৫) অর্থনৈতিক সম্ভাবনাঃ নোয়াখালী অর্থনৈতিক ভাবে একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল। মেঘনার অববাহিকা আর উপকূলের উঠতি ছোট ছোট চর গুলো অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। নোয়াখালীতে ভালো মানের কিছু মিল-কারখানাও আছে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হলে কাঠামোগত উন্নয়ন তরান্বিত হবে। কৃষি উন্নয়নের সাথে নতুন নতুন মিল কারখানা হবে। সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে বহুগুণে। সেই সাথে হাতিয়া নিঝুম দ্বীপের মতো পর্যটন স্পটের গুরুত্বও বাড়বে অনেক। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নোয়াখালীকে বিভাগ করা উচিত।
৬) পিছিয়ে পড়া ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলকে এগিয়ে নেয়াঃ ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধশালী অন্যতম পুরানো এই জেলাটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। অথচ নোয়াখালীর সমসাময়িক অনেক জেলাই বিভাগ বা সিটি হওয়ার ফলে অনেক এগিয়ে গেছে। তাই পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে বিভাগ করার বিকল্প নাই।
বরিশাল অঞ্চলের ছেলে হিসেবে আমি নোয়াখালীর দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষনা করছি। নোয়াখালীকে বিভাগ করা উচিত। অন্তত বৃহত্তর নোয়াখালীকে (নোয়াখালী, লক্ষিপুর, ফেনী) নিয়ে নোয়াখালী বিভাগ করা হোক। কেননা কুমিল্লা বিভাগ হলে নোয়াখালী তার অধীনে থাকা আর চট্টগ্রামের অধীনে থাকা একই কথা। পিছিয়ে পড়া নোয়াখালী পিছিয়েই থাকবে। তাই সরকারের সব দিক বিবেচনায় নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষনা করা উচিত।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, বৃহত্তর নোয়াখালীর ইতিহাস গ্রন্থ, ও নিউজ পেপারের লিংক ইত্যাদি।
নোয়াখালী বিভাগ চাই।
কোন মন্তব্য নেই