স্কার্ফ
রাস্তায় দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ ক্যাম্পাসের এক জুনিয়রের সাথে দেখা। অযথাই গল্প জুড়ে দিলো৷ যদিও আজ এগুলো শোনার মুড নেই।
-এই তোর টিউশনি আছেনা? যা যা তাড়াতাড়ি যা।
-আছে ভাই। তবে একটু পর গেলেও সমস্যা নাই।
-আরে কি বলিস! সাতটার টিউশনি সাতটাই যাবি। সময়ের কাজ সময়ে করবি বুঝছো। যা যা....
ক্যাম্পাসের কাছের জুনিয়রটাকে অনেকটা জোর করেই বিদায় করলাম।
সব সময় হইহুল্লোড় করে মানুষজনের সাথে থাকা পছন্দ হলেও, আজকে একাকিত্বটাই খুব পছন্দ। ভাবলাম, সুপার মার্কেটটা একা একাই ঘুরি। কেউ সাথে থাকবেনা৷ কোন পরিচিত মানুষের সাথে দেখাও যেন না হয়। চলার পথে পরিচিত কারো সাথে হাই হ্যালো করাটাও আজ অপছন্দের।
মার্কেটের সামনে পায়চারি করছি। অনেকদিন পর শহরটাতে এসে মনে হয় সবকিছু বেশ অপরিচিত। কিছুক্ষণ হাটাহাটির পর বোর লাগছে। কেন যেন বাসায়ও যেতে ইচ্ছে করেনা। বিভিন্ন দোকান ঘুরে জুতা দেখছি৷ কেনার টাকা নাই। অভ্যাসগত হিজাব ও বোরকার দোকানেও ঘুরাঘুরির করলাম। বিয়ের আগে সুপার মার্কেটে হিজাব বা বোরকার দোকানের কাছে আসলেই চোখ আটকে যেত। বউকে হিজাব বা বোরকা পরাই বেশি কল্পনা করতাম। এখন আর কল্পনা করতে সাহস হয়না। পছন্দের জিনিসটার দামযে একটু বেশিই। আগে ভাবতাম চাকুরী নিয়ে বিয়ে করবো। বউকে কিনে দেয়ার সামর্থ্য হবে। বিবাহিত বেকার হয়ে কল্পনার জায়গাটাযে ছোট হয়ে গেছে। বউটা অনেক ভালো। দামি কোন কিছুর প্রতিই তার চাহিদা নেই। চল্লিশ বা পঞ্চাশ টাকা দামের কাচের চুড়ি আর বিশ টাকা দামের খোপা ছাড়া আর কোন চাওয়া নেই তার। হয়ত আমি বেকার দেখেই সে এমন করে। নয়ত এই যুগের মেয়েদের কত শত চাহিদা থাকার কথা।
আমার কাছে অল্প কিছু টাকা আছে। ভাবলাম বোরকা না কিনতে পারি একটা স্কার্ফ কিনি। কতইবা দাম হবে। দুইশ বা তিনশই হোক। স্কার্ফ যেটা পছন্দ করলাম দরদামের পর চারশ পঞ্চাশ টাকার নিচে কেনাই যাবেনা। আমার কাছে ওই পরিমানে টাকাই নেই। কয়েকটা দোকান ঘুরেও দাম তিনশর মধ্যে আনতে পারলাম না। আমার আবার যেটা একবার পছন্দ হবে ওটা ছাড়া অন্যটা আর সায় দেবেনা৷ হয়ত কিনবো নয়ত কিনবোনা। যাইহোক আর কেনা হলোনা।
মার্কেট থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে নিচ তলায় আসতেই অনুভব করলাম সিড়ি থেকে কেউ একজন নামতে নামতে ডাকছে। এই সফিক। এই সফিক। সফিক ...
-আপনি ডাকছেন? বলুন।
-তুমি আমাকে চিনতে পারনি?
-ও তুমি। নিমা। কেমন আছো? নেকাব পরা দেখে চিনতে পারিনি৷ বল বল কি খবর তোমার কেমন আছো?
-ভালো। তুমি? অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি তোমাকে। সেই তিনতলা থেকে। তোমাকে শুনতে শুনতে নিচ তলায় আসতে হলো। কানে কম শোন নাকি? আমিতো দৌড়ও দিতে পারছিনা।
-না। আসলে আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবছিলাম। তাই হয়ত খেয়াল করিনি৷
- খেয়াল কেন করবা? তুমিতো এমনই সব সময়৷ ছন্নছাড়া। খেয়াল টেয়াল কম।
-অনেকদিন পর দেখা তোমার সাথে। প্রায় তিন বছর।
-নাহ। দুই বছর তিন মাস।
-বাহ মাসও মনে রেখেছো।
-হিসেব করে দিনও বলতে পারবো।
-থাক বলতে হবেনা। তোমার হাজবেন্ড কোথায়?
-ওনিতো সিঙ্গাপুরে আছেন। তুমি কি করো? শুনলাম বিয়ে করছো। বউ কেমন আছে? দেখাও দেখাও ছবি দেখাও।
-আমি কিছুই করিনা। পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি। বিয়ের কথা কার থেকে শুনছো?
-শুনেছি।
- কিভাবে? তোমার সাথেতো আমার কোনই যোগাযোগ নেই। আমার কোন ফ্রেন্ড বা পরিচিত কাউকেই তুমি চিনোনা। আমার আইডিতেও তুমি নাই।
-আসলে কেউ আমাকে বলেনি। আমি তোমার ফেবু আইডিতেই দেখেছি৷ মাঝেমাঝে সার্চ দিয়ে তোমার আইডিতে ঢুকি।
- তো রিকুয়েস্ট দিলেনা কেন?
- কখনোই দিবোনা৷ দেয়ার কথাও ছিলোনা। যেদিন তোমাকে আমার আইডি ব্লক করতে বলেছি। ওইদিনই আমি ওই আইডি ডিএক্টিভ করছি। আর নাম্বার তিনটাও বন্ধ করে দিয়েছি। আর কখনো ওপেন করিনি। নতুন আইডি দিয়ে সার্চ দিয়ে যা তোমার আইডিতে ঢুকতাম।
-এতো অভিমান তোমার?
- কিসের অভিমান। এখন আর অভিমান নেই। রাগ তোমার উপর। রাগ। ক্ষোভও আছে৷
-কেন কেন?
-তুমি নাকি পাঁচ বছরেও বিয়ে করবেনা?
-আমি কি করতে চাইছি? বাবা মা জোর করলো আরকি। ওই তোমার মত অবস্থা।
- হা হা৷ ছেলেদের বেলায় এমন হয় প্রথম শুনলাম৷
-রাগ ক্ষোভের সাথে ঘৃণা নেইতো আমার প্রতি?
-না।
-সত্যি?
-না নেই। বাদ দাওতো এসব। তোমার বউয়ের ছবি দেখাও? দেখাও?
- আমার বউ তেমন সুন্দর না। এই দেখ।
-কি বল। সুন্দরইতো। চুল বড় তাইনা?
-হুম আছে মোটামুটি।
-অনেক ভালোবাসে তোমাকে তাইনা?
-ভালোবাসে। তবে অনেক ভালোবাসে কিনা জানিনা।
আমাদের কথোপকথনের মধ্যেই হঠাৎ নিমার ছোট বোন সিমা আসলো। সাথে এক বছরের একটা বাচ্চা। নিমা বললো, এটা আমার ছেলে।
হাই বাবু। গাল ধরে আলতো চাপ দিয়ে বললাম। আসো আসো। আমার কোলে আসো। আসলোনা। জোর করতে গেলে কান্না করে দিলো।
-দেখ, আমার ছেলে তোমাকে পছন্দ করেনা।
-হুম। সেটাইতো দেখছি। তবে নতুন দেখছেতো। এমনিতে পিচ্চি পোলাপান কিন্তু আমাকে খুব পছন্দ করে। যাইহোক, শোন আমি বাসায় যাবো। অনেকদিন পর দেখা হয়ে ভালো লাগলো। ভালো থেকো।
-শোন। একটু পরে যাও। একটা রিকুয়েস্ট ছিলো রাখবে?
- কি বলো?
-আগে বলো রাখবে কিনা?
-রাখার মত হলে রাখবো।
-তোমার বউকে কিছু কিনে দিতে চাই৷
-আরে কি বলো। না না। কি কিনে দিবে তুমি? কিচ্ছু লাগবেনা। আমি গেলাম।
-বলছিলেনা কথা রাখবে।
অনেক পিড়াপীড়ির পরে, আমাকে নিয়ে সোজা তিন তলায় উঠে হিজাবের দোকানে গেল। আমার পছন্দ করা স্কার্ফটাই কিনে দিলো। হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা তোমার বউকে দিবে। আর বলবে আমার এক পাগল বন্ধু তোমাকে গিফট করেছে। আমি অবাক হলাম। এটা আমি কিছু আগে পছন্দ করে গেলাম। ও কিভাবে জানলো। কি জানি। জিজ্ঞাসাও করিনি। কাকতালীয় হবে হয়ত।
যাইহোক, চলে আসার সময় ওর ছেলেকে আবার কোলে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। পারলাম না।
-এই ওর নাম কি রেখেছো?
-সফিক।
-ওর নাম কি বলো?
-সফিক।
-কি বলো! ওর নাম সফিক রেখেছো নাকি?
-সত্যিই ওর নাম সফিক।
-আশ্চর্য! কি বল এসব? আমার নামটাই রেখে দিলে। কে রেখেছে?
-কেন? আমি নিজেই রেখেছি।
-আর কোন নাম পেলেনা। কেন আমার নামটাই রাখতে গেলে?
...................................................................................
-মুহিববুল্লাহ আল মামুন
১৫-১১-২০১৮
কোন মন্তব্য নেই